অনলাইন গেমিংয়ে Ping কে যেভাবে নিয়ন্ত্রণে রাখবেন

অনলাইন গেমিংয়ে Ping বা Latency ব্যাপারটা সম্পর্কে আমরা সবাই কম বেশি করে পরিচিত। বিশেষ করে বর্তমানে পাবজি মোবাইল গেমের কারণে আমাদের সবাই এই পিং বা Latency কে চিনে থাকি। আর অনলাইন গেমিংয়ের অন্যতম বড় সমস্যা হলো বেশি পিং। বেশি পিং থাকলে আপনার খেলার অভিজ্ঞতাই পাল্টে যাবে! কারণ পিং বা Latency এর উঠানামা বা কম বেশি থাকার ব্যাপারটা সরাসরি একজন অনলাইন গেমারের গেমপ্লে পারফরমেন্সের উপর গিয়ে পড়ে থাকে। আপনার কাছে শক্তিশালি ডিভাইস থাকা স্বত্বেও বেশি পিংযুক্ত সার্ভারে গেম খেললে আপনি বিভিন্ন প্রকারের খোঁট / ল্যাগের দেখা পাবেন। তাই শক্তিশালি ডিভাইস (যা FPS এ সহায়তা করে) এর পাশাপাশি ভালো পিং (নূন্যতম) এরও প্রয়োজন।

একজন অনলাইন গেমার হিসেবে কম পিং পাবার জন্য আপনি নিচের পদ্ধতিগুলো অনুসরণ করতে পারেন। তবে মনে রাখবেন যে, অনলাইন গেমের পিং বিষয়টি ৮০% ভাগই নির্ভর করে নিচের ১ম পদ্ধতির উপর:

১) নিকটস্থ সার্ভার সিলেক্ট করুন

পিং বেশি থাকার সবথেকে বহুল প্রযোজ্য কারণ হলো আপনি নিকটবর্তী সার্ভারটি সিলেক্ট করেননি। গেমিং সার্ভার চয়েজের উপর আপনার গেমের পিং প্রধানত নির্ভর করে থাকে। আপনার লোকেশন (বাংলাদেশ) এর যত কাছে গেমিং সার্ভারটি হবে, গেমে আপনার পিং তত কম থাকবে। যেমন Dota গেমে আপনি যদি EU মানে ইউরোপের সার্ভারটি সিলেক্ট করে খেলেন তাহলে দেখবেন যে আপনার পিং ১৫০ থেকে ২৫০ ক্রস করেছে, অন্যদিকে SEA মানে সাউথ এশিয়া সার্ভার দিলে দেখবেন পিং এক লাফে কমে গিয়ে ৯০/৮০ তে নেমে গিয়েছে। আর ডটা গেমে ইন্ডিয়া সার্ভারও রয়েছে তাই ইন্ডিয়া সিলেক্ট করলে আপনি সবথেকে কম পিং (৩০/৪০) উপভোগ করতে পারবেন। তাই যে সকল গেমে সার্ভার সিলেক্টের অপশন রয়েছে সেখানে আপনি অবশ্যই আপনার সবথেকে নিকটের সার্ভারটি সিলেক্ট করবেন।

২) অদরকারি প্রোগ্রাম ক্লোজ করুন

অনলাইন গেমস খেলার সময় বিশেষ করে গেম শুরু আগে আপনার উচিত একবার ব্যাকগ্রাউন্ড অ্যাপ্লিকেশনগুলো চেক করে নেওয়া এবং অদরকারি প্রোগ্রামগুলোকে ক্লোজ করে দেওয়া। অনেক সময় দেখা যায় যে সঠিক গেমিং সার্ভার সিলেক্ট করার পরেও আমাদের পিং উঠা নামা করতে থাকে বা ল্যাগ দিতে থাকে। এর অন্যতম প্রধান একটি কারণ হচ্ছে আপনার পিসির ব্যাকগ্রাউন্ডের চলমান প্রোগ্রামগুলো তাদের সুবিধামতো আপনার ইন্টারনেট ব্যান্ডউইথ টেনে নেয়। আর সে কারণেই পিং আপডাউন করতে থাকে।

আর অদরকারি রানিং প্রোগ্রামগুলোকে খুঁজে বের করা এবং তাদেরকে বন্ধ করার সবথেকে সহজ ও কার্যকরি পদ্ধতি হচ্ছে টাস্ক ম্যানেজার। তবে টাস্ক ম্যানেজার থেকে সকল রানিং প্রোগ্রামকে কিন্তু আপনি বন্ধ করতে পারবেন না (যেমন সিস্টেম প্রসেসগুলো)।

বি:দ্র: আপনি যদি টরেন্ট অ্যাপ ব্যবহার করে থাকেন তাহলে আমি সবার আগে বলবো যে, Torrent কে বন্ধ করে দিন। টরেন্ট থেকেই আপনার বেশিভাগ ব্যান্ডউইন্ড টেনে নেওয়া হয়ে থাকে।

৩) অস্থায়ীভাবে আপডেট অফ

অটোমেটিক আপডেটগুলো সাধারণত ব্যাকগ্রাউন্ডে সম্পাদিত হয়ে থাকে। যেমন উইন্ডোজ আপডেট, অ্যান্টিভাইরাস আপডেট, ড্রাইভার আপডেট ইত্যাদি। কিন্তু সমস্যা হচ্ছে এই অটোমেটিক আপডেটগুলো “অটোমেটিক”ভাবেই যখন তখন চালু হয়ে যেতে পারে। আর এতে আপনার ব্যান্ডউইথ এরও “অটোমেটিক”ভাগিদার এসে যাবে। এখন আপনাকে আমি কখনোই বলবো না যে এইসব অটোমেটিক আপডেট একদম বন্ধ করে রাখতে কারণ আপডেটগুলো আপনার পিসির জন্য প্রয়োজনীয়। কিন্তু কথা হচ্ছে, এই আপডেটগুলো আপনি কয়েক ঘন্টা পরেও দিতে পারবেন; কিন্তু অনলাইন গেমকে আপনি ১ সেকেন্ডের জন্যও Pause করে রাখতে পারবেন না। তাই আপনি গেমিংয়ে বসার আগে এইসকল অটো আপডেটকে বন্ধ করে রেখে দিয়ে নিশ্চিত থাকতে পারেন। পরবর্তীতে গেমিং সেশন শেষ হলে আবারো অটো আপডেট অন করে নিলেন।

৪) রাউটার রিসেট

যদি মোবাইলে বা ল্যাপটপে অনলাইন গেমিং করে থাকেন তাহলে নিশ্চিতভাবে বলা যায় যে আপনি রাউটারের WiFi এর সাহায্যেই খেলছেন। এখন রাউটারটির বিভিন্ন ইস্যুর কারণেও পিং উঠানামা করতে পারে। বিশেষ করে আপনি যদি অনবরতভাবে টানা রাউটার দিনের পর দিন ব্যবহার করতে থাকেন তাহলে রাউটারে ম্যালফাংশন দেখা দেওয়াটা স্বাভাবিক। তাই আপনি রাউটারকে সম্পূর্ণভাবে বন্ধ করে দিন (প্লাগ আউট)। ৫/১০ মিনিট বন্ধ রাখার পর আবারো রাউটার চালু করুন। তাহলে দেখবেন পিং আগের মতো হয়ে গিয়েছে। আর এই ধরণের ম্যালফাংশন থেকে বেঁচে থাকতে রাতে ঘুমানোর আগে রাউটার বন্ধ করে দেওয়া উচিত।

৫) ক্যাবল কানেক্টশন

আর WiFi দিয়ে খেলার আরেকটি সমস্যা হচ্ছে এখানে General ভাবেই পিং একটু বেশি থাকে (সকল ক্ষেত্রে নয়)। আমার নিজের কথাই বলি, একই রুমে আমার ডেক্সটপ এবং ল্যাপটপ রয়েছে, ডেক্সটপে রাউটারের ক্যাবল কানেক্টশন দেওয়া আর ল্যাপটপে WiFi দেওয়া। এখন দেখা গেল যে, একই গেম একই সার্ভারে ডেক্সটপে খেললে পিং থাকে 28/30ms এর মতো কিন্তু সেখানে ল্যাপটপে WiFi দিয়ে খেললে দেখা যায় যে পিং 58/60ms নরমালি থাকে। কিন্তু ল্যাপটপে ওয়াইফাইয়ের বদলে সরাসরি ক্যাবল কানেক্টশন (Ethernet) দিয়ে খেললে পিং নেমে আসে 28/30ms এ! তাই সুযোগ থাকলে WiFi না ব্যবহার করে সরাসরি রাউটার থেকে Ethernet এর মাধ্যমে ব্রডব্যান্ড নেট ব্যবহার করুন। এতে কম পিং এর পাশাপাশি FTP এবং ইউটিউব ইত্যাদি সার্ভার থেকেও ডাউনলোড স্পিডে বেশ বুস্ট পাবেন।

৬) ব্যাকগ্রাউন্ড ডাউনলোড / আপলোড অফ

আপনি যত দ্রুত গতিরই নেট ব্যবহার করে না কেন সবসময় অনলাইন গেমে বসার আগে চেক করে নিবেন যে আপনার ডিভাইসে ব্যাকগ্রাউন্ডে কোনো ডাউনলোড বা আপলোড চলছে কিনা। এদের মধ্যে টরেন্ট আর অটো আপডেট নিয়ে পোষ্টে আগেই কথা বলা হয়েছে। কিন্তু আপনি নিজেই যদি কোনো বড় ফাইল (যেমন মুভি, গানের অ্যালবাম) ডাউনলোড দিয়ে গেমে ঢুকেন তাহলে দেখবেন যে এমনিতে পিং একটু বেশি রয়েছে।

৭) WiFi নিয়ন্ত্রণ

আমাদের দেশে ওয়াইফাই কথাটি শুনলেই এমনিতেই গণহারে ডাউনলোড ও ইউটিউব দেখার প্রথাটি সামনে চলে আসে। আর একটি WiFi তে যত বেশি ডিভাইস / ইউজার হবে ওয়াইফাইয়ের গতিও কতগুলো ভাগে বিভক্ত হয়ে যাবে। আর তার উপর যদি কানেক্টেড ডিভাইসগুলোতেও যদি ডাউনলোড বা ইউটিউব দেখা হয় তাহলে আপনি নিজেও অনলাইনে গেমে ঢুকে দেখবেন যে পিং আকাশ ছোঁয়া! আপনার পিসির সকল ডাউনলোড আপলোড নিয়ন্ত্রণে রেখেও যদি দেখেন যে পিং বেশি তাহলে চেক করে দেখুন আপনার ওয়াইফাই নেটওর্য়াকে কোন কোন ডিভাইসটি কতটুকু ব্যান্ডউইথ খেয়ে নিচ্ছে।

৮) রাউটারের কাছে আসুন

WiFi দিয়ে গেম খেলার সময় চেষ্টা করবেন যে যতটুকু পারা যায় রাউটারের কাছে গিয়ে খেলতে। কারণ এক রুমের রাউটার অন্য রুমে গিয়ে আপনি WiFi সিগন্যাল কম পাবেন এবং সেটা আপনার ব্যান্ডউইথও একইসাথে কম করে ফেলবে। তাই যে রুমে রাউটার রয়েছে বা যে রুমে আপনার পিসি / ল্যাপটপ ব্যবহার করবেন সে রুমেই রাউটারও বসিয়ে ফেলুন।

৯) Whitelist করুন

বিভিন্ন ভাবে গেমের সার্ভারগুলোকেও নেট আদান প্রদানের সময় আপনার পিসির ফায়ারওয়াল এবং অ্যান্টিভাইরাস থেকে স্ক্যান করা হয়ে থাকে। এই প্রক্রিয়ার জন্যেও আপনি অনলাইন গেমে খুবই সামান্য Delay এর দেখা যাবেন। কিন্তু মাঝে মাঝে অনেক সময় দেখা যায় যে ফায়ারওয়াল বা অ্যান্টিভাইরাস বিভিন্ন কারণে পুরো সার্ভার থেকেই নেট কে Deny করে দেন; তখন দেখবেন যে আপনি গেমে কানেক্টই হতে পারছেন না। এই সকল সমস্যা থেকে বেঁচে থাকতে আপনার পিসির ফায়ারওয়াল এবং অ্যান্টিভাইরাস প্রোগ্রামে আপনার অনলাইন গেমকে Whitelist করে রাখুন।

১০) ISP কে জানান

উপরের সবগুলো পদ্ধতি টেস্ট করার পরেও যদি আপনার গেমের পিং হাই থাকে তাহলে এবার আপনি সরাসরি আপনার ISP বা ইন্টারনেট সার্ভিস প্রোভাইডার (যে কোম্পানির ব্রডব্যান্ড আপনি ব্যবহার করছেন) এর সাথে এই হাই পিং নিয়ে যোগাযোগ করতে পারেন, তারা আপনাকে এর গ্রহণযোগ্য সমাধান বলে দিতে সাহায্য করবে। হয়তো আপনাকে আরো উচ্চগতির প্যাকেজে মাইগ্রেড করতে হতে পারে কিংবা আপনি চাইলে আরো ভালো ISP তে সুইচ করতে পারেন।

পরিশিষ্ট:

গেমিংর এর কম পিং এর জন্য সুপার ডুপার স্পিডের নেট প্যাকেজের কোনো ভূমিকা থাকে না। এটা আপনার নেটের আপলোড স্পিড এর উপর অনেকাংশে নির্ভর করে । তাই কম পিং পাবার জন্য 10Mbps এর প্যাকেজ থেকে 15Mbps এর প্যাকেজে আপগ্রেড করার পরেও দেখবেন যে উল্লেখযোগ্য কোনো সুবিধা হয়নি। তাই আপনার ISP কে বলে আপনার আপলোড স্পিডের লিমিটকে বাড়িয়ে নিতে বলবেন। একই সাথে WiFi তে গেমিং করলে অবশ্যই ভালো রাউটার ব্যবহার করবেন আর রাউটারটি নিয়মিত যত্ন নিবেন, গেমিং রাউটার একমাত্র প্রফেশনাল গেমার না হলে না নেওয়াই ভালো আর এমনিতেও প্রফেশনাল গেমাররা WiFi তে খুবই কম গেমিং করে থাকেন। অন্যদিকে আপনার শহরের পিক / অফ পিক ঘন্টাগুলো জেনে নিতে পারেন বা খেয়াল করতে পারেন, আর ওই সকল সময়ে গেমিং থেকে বিরত থাকতে পারেন। যেমন আমার এলাকায় সন্ধ্যা ৭ টা থেকে রাত ১২টা পর্যন্ত ব্রডব্যান্ড লাইনের পিক Hour থাকে তখন এমনিতেই নেট স্লো থাকে।

বোনাস টিপস:

১) মাঝে মাঝে রাউটারকে বাইরে এবং ভেতর থেকে পরিস্কার করুন, বাইরের ধুলা এবং ভেতর বলতে সফটওয়্যারের দিক থেকে রাউটারকে ফ্ল্যাশ এবং রিসেট মারুন।

২) আউটডেটেড বা পুরোনো রাউটার থাকলে এটাকে আপনি বদলিয়ে নিতে পারেন। এখন বাজারে হাজারের নিচেও রাউটার পাওয়া যায়।

৩) গেম খেলার সময় অবশ্যই VPN বা Proxy ব্যবহার করা থেকে বিরত থাকবেন। এটা হাই পিং এর পাশাপাশি অনলাইন গেম থেকে একাউন্ট ব্যান হবারও চান্স থাকে।

৪) ডিভাইস সার্পোট থাকলে 2.4GHz এর স্থানে 5GHz WiFi কানেক্টশন ব্যবহার করুন।

৫)  অনেক সময় বিভিন্ন ভাইরাস এবং Malware এর বিভিন্ন ইস্যুর কারণেও পিং উঠানামা করতে পারে। এজন্য নিয়মিত অ্যান্টিভাইরাসকে আপডেটেড রাখুন ।

৬) উইন্ডোজ যে বিল্ট ইন Location সার্ভিস রয়েছে যা আপনার exact লোকেশন জানতে পারে এবং আপনার লোকেশন অনুযায়ী আপনাকে বিভিন্ন ধরণের সেবা এবং সার্ভিস উপহার দিয়ে থাকে। এটা বাংলাদেশের জন্য তেমন কোনো কাজেরই না বরং এটার জন্য উল্টে আপনাকে ব্যান্ডউইথ খরচ করতে হয়। আপনি Settings > Privacy > Location > Location Service এটাকে বন্ধ করে দিতে পারেন।

 

Share This Article

Search