বর্তমানে আমাদের প্রায় ৯০% লোক স্মার্টফোন ব্যবহার করে থাকে। স্মার্টফোনের দাম এখন সাধারণ মানুষের হাতের নাগালে চলে আসায় এর ব্যবহারকারীর সংখ্যা বেশ বৃদ্ধি পেয়েছে গত কয়েক বছরে। স্মার্টফোনের অনান্য সকল বিষয়ের মতোই এর ব্যাটারিটাও কিন্তু “স্মার্ট”। আর ব্যাটারির স্মার্টনেস ধরে রাখতে আমাদেরকে নিয়মিত কিছু রুলস ফলো করা উচিত। আর সে সমস্ত রুলস বা স্মার্টফোনের স্মার্ট ব্যাটারিকে চার্জিং করতে গিয়ে আমরা নিয়মিত যে সকল ভুলগুলো করে থাকি সেগুলো নিয়েই আমার আজকের এই পোষ্ট। উল্লেখ্য যে আজকের পোষ্টটি কোনো নিদির্ষ্ট টাইপের স্মাটফোনের উদ্দেশ্যে (যেমন আইফোন) নয়। আজকের বিষয়গুলো সাধারণ ভাবে সকল স্মার্টফোনের জন্যই প্রযোজ্য হবে। তো চলুন দেখে নেই কি কি ভুলগুলো আমরা প্রতিনিয়তই করছি।
প্রথমবারে ১০০%!
প্রথম টিপস হচ্ছে স্মার্টফোন কেনার পর প্রথমবার চালানোর আগে ১০০% চার্জ করে নেওয়া! আমাদের অনেকেই এই পদ্ধতিটি ফলো করে থাকি, আর অনেক সময় শপের বিক্রেতাও আমাদেরকে বলে দেন যে বাসায় নিয়ে প্রথমে ম্যাক্স চার্জ করে নিয়ে তারপর ব্যবহার করবেন। কিন্তু এটা কিন্তু একটি ভুল তথ্য!
আসলে এটি একটি মিথ (Myth) বা খাঁটি বাংলায় আমরা যাকে “কুসংস্কার” বলে থাকি। অর্থাৎ এর কোনো উপকারিতা নেই। কারণ মুল বিষয় হচ্ছে একটি স্মার্টফোনের ব্যাটারি সবথেকে বেস্ট সার্ভিস দেয় ৪০ থেকে ৮০% চার্জে। তাই চেষ্টা করবেন সবসময় ৪০ থেকে ৮০% চার্জের মধ্যেই আপনার মোবাইলকে রেখে দিতে। তবে আরেকটি বিষয় খেয়াল রাখবেন যে স্টোর থেকে ফোন কেনার পর যদি দেখেন সেটার চার্জ ৪০% এর নিচে থাকে তাহলে সেই ডিভাইসকে না কেনাই উত্তম হবে।
চারজিঙ্গের সময় ফোন ব্যবহার না করা!
টাইটেলটি আবারো পড়ুন। এখানে চাজিংয়ের সময় ভুলগুলো সম্পর্কে বলা হয়েছে, কি করবেন সেটা কিন্তু বলা হয়নি। তারমানে এই যে অনেকেই মনে করেন যে চার্জিংয়ের সময় ফোন টেপাটিপি বা চার্জিংয়ের সময় ফোন ব্যবহার করলে সেটা ব্যাটারির এবং চার্জিংয়ের মধ্যে ক্ষতি করে বলে মনে করে থাকেন। কিন্তু এটাও একটি কুসংস্কার!
আসলে আপনি চার্জিংয়ের সময় যাবতীয় “স্বাভাবিক” কাজ মোবাইলে করে যেতে পারবেন। কিন্তু হাই ইনটেন্সিভ কাজ যেমন গেমিং, ফোনে ভিডিও কল কিংবা ইউটিউবে মুভি দেখা ইত্যাদি করলে চার্জিং টাইম একটু বেশি লাগবে। আবার অন্যদিকে চার্জরত অবস্থায় হাই ইনটেন্সিভ কাজ করলে ব্যাটারি গরম হয়ে যেতে পারে এবং মূলত গরম থেকেই ক্ষতিটা হয়ে থাকে। তাই এখানে আমি বলবো যে চার্জরত অবস্থায় ফোন না ধরাই উত্তম কিন্তু ইমার্জেন্সি অবস্থায় যে ফোন ধরতে পারবেন না এমনি কিন্তু ভুল!
চার্জার বিড়ম্বনা!
আমরা অনেকেই মনে করে থাকি যে ফোনটি যে ব্রান্ডের যেটির নিজস্ব চার্জার ছাড়া অন্য ব্রান্ডের চার্জারে ডিভাইস চার্জ দিলে সেটা ব্যাটারির জন্য ক্ষতিকর । এটাও একটি ভুল ধারণা। লক্ষ্য করুন আমি এখানে অন্য ব্রান্ড বলেছি! মানে আপনি গ্যালাক্সি এস১০ কে ওয়ানপ্লাসের ফার্স্টচার্জার দিয়ে চার্জ করলে ব্যাটারির কোনো ক্ষতি হবে না। কিন্তু চাইনিজ সস্তা চার্জার ব্যবহার করলে তো বিপদে পড়বেনই। আর সবসময় মনে রাখবেন ব্রান্ড অন্য হলে যাতে সেটার চার্জিং পাওয়ার (Watt) যাতে সঠিক থাকে। যেমন আপনার ডিভাইসটি 17 Watt পর্যন্ত সার্পোট করে সেখানে আপনি ২০ ওয়াটের চার্জার ব্যবহার করলে চার্জ তো দ্রুত হবেই না উল্টো ব্যাটারির ক্ষতি হতে পারে। কিন্তু আইফোনের বেলায় সবসময়ই চেষ্টা করবেন অ্যাপলের চার্জারগুলোই ব্যবহার করতে।
ফোন অফ করে চার্জ!
আপনি যদি ব্যাটারি লাগিয়েই ফোনকে ৫/৬ মাসের জন্য বন্ধ করে রাখেন তাহলে সেটার ব্যাটারি ক্ষতির মুখে পড়বেই! কারণ বর্তমান যুগের স্মার্টফোনের ব্যাটারিকে আপনি খুলে রাখতে পারবেন না। সেটা তো আছেই আবার অনেকেই মনে করেন যে ফোন অফ করে চার্জ দিলে চার্জ দ্রুত হবে এবং এটা ব্যাটারির জন্য বেশ ভালো! এটাও একটি কুসংস্কার ছাড়া কিছুই নয়। আপনার স্মার্টফোনটি ফার্স্টচার্জ থাকুক বা না থাকুক। ফোন অন করে চার্জ দিলে যতক্ষনই লাগবে, ফোন অন করে দিলে ঠিক ততখনই লাগবে! তবে প্রতি সপ্তাহে একবারের জন্য হলেও ফোনটি বন্ধ করে ২/৩ ঘন্টার জন্য রেখে দিন। তাহলে আপনার ডিভাইসটি ভালো পারফরমেন্স দিয়ে যাবে।
ব্যাটারি ট্রেনিং!
আমাদের মাঝে অনেক “পন্ডিত” রয়েছেন যারা তাদের স্মার্টফোনের ব্যাটারিকে ট্রেনিং করিয়ে থাকেন। এজন্য চার্জ সম্পূর্ণ রূপে খেয়ে নিয়ে তারপর সবসময় ৫০-৬০% করে থাকেন তারপর আবার একই প্রক্রিয়া রিপিট করতে থাকেন। তারা মনে করেন যে স্মার্টফোনের ব্যাটারিতেও মেমোরি থাকে আর এটাকেও কাস্টমাইজেশন করে নেওয়া যায়। এটাও একটি ভুল ধারণা।
রাতকানা!
আমাদের অনেকেই মনে করেন যে যে রাত্রের বেলায় চার্জ দিয়ে ঘুমিয়ে গেলে সেটা সারারাত চার্জ হবে এবং সেটা ফোনের ব্যাটারির জন্য ক্ষতিকর! এটাও একটি ভুল ধারণা! আপনার ফোনটি কিন্তু একটি “স্মার্ট”ফোন! আর স্মার্ট দেখেই ফোনটি জানবে যে কখন আপনার ব্যাটারির আর কোনো পাওয়ারের প্রয়োজন নেই। ১০০% চার্জ হবার পর আপনি ফোনটি প্লাগইন করে রাখলেও সেটা থেকে ডিভাইসে কোনো পাওয়ার টানবে না। তবে প্রথমেই বলেছি যে স্মার্টফোনের ব্যাটারির দীর্ঘআয়ু ধরে রাখতে ৪০ থেকে ৮০% পর্যন্ত চার্জ করার অভ্যাস করুন, তাই রাত্রিরে ফুল চার্জ হবে বিধায় এটা থেকে বিরত থাকুন। তবে ইমার্জেন্সি প্রয়োজনে অবশ্যই রাত্রে বেলায় চার্জ করিয়ে নিতে পারবেন।
গরম-ঠান্ডার খেলা!
অনেকেই স্মার্টফোনের ব্যাটারি লাইফ বৃদ্ধির জন্য স্মার্টফোনকে ফ্রিজের ভিতরও ঢুকিয়ে রেখে দেন! হ্যাঁ! এইরকম পাবলিকও রয়েছে আমাদের মাঝে। কিন্তু এটায় কোনো সুবিধা তো হবেই না উল্টো স্মার্টফোনের ক্ষতি হবে, আর ব্যাটারির তো ক্ষতি রয়েছেই। স্মার্টফোনের ব্যাটারিগুলো অতিরিক্ত ঠান্ডা এবং অতিরিক্ত গরম দুটো পরিবেশেই ক্ষতির সম্মুখে পড়ে থাকে।
অ্যাপের জাদু!
প্লেস্টোর কিংবা অ্যাপল স্টোরে বিভিন্ন এবং শতশত ব্যাটারি বুস্টার রয়েছে। এগুলোর ভাষ্যমতে এগুলো আপনার টাস্ক ম্যানেজার হিসেবে কাজ করতে পারবে। বিভিন্ন চালুরত অ্যাপ এবং সার্ভিসগুলোকে বন্ধ করে দিয়ে এগুলো আপনার ব্যাটারি লাইফকে বুস্ট করতে পারবে এবং চার্জিং টাইমও দ্রুততর করতে পারবেন। যেগুলো সবই ভূয়া! কোনো অ্যাপ দিয়ে আপনি আপনার ব্যাটারির পরিচর্যা করতে পারবেন না।
চিরস্থায়ী চার্জার!
অনেকেই মনে করে থাকেন যে চার্জারকে স্থায়ীভাবে কোনো প্লাগে প্লাগইন করিয়ে রাখলে সেটা চার্জারের জন্য ক্ষতিকর হয়ে থাকে এবং সেটার মাধ্যমে স্মার্টফোনের ব্যাটারির উপর বিরূপ প্রভাব ফেলতে পারে। এটাও একটি ভুল ধারণা। আপনি অবশ্যই কোনো টেনশন ছাড়াই চার্জারকে মাসের পর মাস প্লাগইন করে রাখতে পারেন। তবে এখানে কয়েকটি কথা রয়েছে:
১) চাইনিজ সস্তা চার্জার হলে এভাবে প্লাগইন করে না রাখাই উত্তম
২) চার্জার যদি অতিরিক্ত গরম হয়ে যায় তাহলেও খুলে রাখুন
৩) চার্জার প্লাগইন থাকা অবস্থায় যদি আর্থি হয় কিংবা উল্টা পাল্টা সাউন্ড আসে তাহলে চার্জারটাই পাল্টে নিন
৪) ঘন ঘন বিদ্যুৎ আপডাউন হলে খুলে রাখুন
৫) আপনার বাসায় যদি কুকুর বিড়াল পোষ্য হয়ে থাকে তাহলেও প্লাগইন করিয়ে রাখাটা ঝুঁকিপূর্ণ
৬) বাসায় যদি বজ্রপাতের প্রক্টেশন দেওয়া না থাকে
৭) বাসায় যদি পানির লিক থেকে থাকে
উপরের পরিস্থিতি আপনার হলে সবসময় চার্জার প্লাগইন করা থেকে বিরত থাকুন।
পিসি চার্জিং!
পিসি বা ল্যাপটপ থেকে USB ক্যাবলের মাধ্যমে কোনো ফাইলস আদান প্রদানের সময় দেখবেন যে আপনার ফোনটি চার্জ হচ্ছে। আমাদের অনেকেই রয়েছেন যারা এই ভাবেই তাদের ডিভাইসকে চার্জ দিয়ে থাকেন। যেটা করা কখনোই উচিত নয়। একে তো এটা ল্যাপটপের ক্ষতি করবে এবং এটা থেকে আপনার ব্যাটারিও যথাযথ ভোল্টেজ টেনে নিতে পারবে না। তাই পিসি দিয়ে ডিভাইস চার্জিংর থেকে বিরত থাকুন।
যত দোষ WiFi, GPS, Bluetooth ঘোষ!
অনেকেই মনে করেন আবার অনেক জায়গায় “ব্যাটারি টিপস” সেকশনেও দেখবেন যে বলা থাকবে যে ব্যাটারি লাইফ বাড়াতে এবং চার্জিয়ের সময় WiFi, GPS, Bluetooth সার্ভিসগুলোকে বন্ধ করে নিতে বলা থাকে। কিন্তু লক্ষ্য করলে দেখবেন যে Data Use এর থেকে WiFi বেশ কম চার্জ খেয়ে থাকে। আর মনে রাখবেন WiFi , GPS, Bluetooth এগুলো ON থাকলেও যতক্ষণ পর্যন্ত না এই সার্ভিসগুলোকে ব্যবহার করা হচ্ছে ততক্ষণ এগুলো তেমন চার্জ টানবে না।
পরিশিষ্ট
এবার কোনো ভুল ধরবো না! বরং আপনার জন্য কিছু টিপস দিয়েই আজকের পোষ্টটি শেষ করছি।
ক) কখন ফোন চার্জ দিবেন?
> ৪০% থেকে ৮০% বা ৯০% হচ্ছে ব্যাটারির জন্য সুসময়। তাই ৪০% এর নিজে নামলেই চার্জে দিন এবং ৮০ থেকে ৯০% হলেই চার্জ খুলে ফেলুন। তবে মাসে একবার পুরো চার্জ শেষ করে একদম ১০০% চার্জ দিয়ে নিবেন।
খ) রাত্রের বেলায় চার্জ?
> কখনোই না। তবে দরকার লাগলে(For Emergency) দিতে পারেন। তবে এই অভ্যাস যাতে প্রতিদিন রিপিট না হয় সেটাও খেয়াল রাখবেন।
গ) ফাস্ট চার্জিংয়ে ডিভাইসের ক্ষতি হয়?
>অবশ্যই! বিশেষ করে অতিরিক্ত ফাস্ট চার্জ ব্যবহার করলে। যেমন ডিভাইসের বক্সে ১৭ ওয়াটের চার্জার দেওয়া থাকলেও বলা হয়ে থাকে যে এই ডিভাইসটি ২৭ ওয়াট পর্যন্ত চার্জার সার্পোট করে কিন্তু বক্সে কম দেওয়ার ও একটি কারণ রয়েছে। তবে প্রয়োজনের সময় অবশ্যই ম্যাক্সিমাম সার্পোটেড চার্জার ব্যবহার করতে পারেন কিন্তু সবসময় দ্রুত চার্জিং কিন্তু আপনার ডিভাইসের জন্য ক্ষতিকর।