বর্তমানে বাজেট স্মার্টফোনগুলো হয়ে উঠেছে প্রতিযোগীতার চরম শিখরে। আগে বাজেট স্মার্টফোন সেক্টরে খুব কম মডেল পাওয়া যেত, আর এখন ইন্ডিয়ায় শাওমি, রিয়েলমি ব্রান্ড চলে আসায় দেখা যায় যে ১৫ ২০ দিন পর পর নতুন ডিভাইস রিলিজ পাচ্ছে। বাজেট সেগমেন্ট হয় মিড রেঞ্চ স্মার্টফোনগুলো একটি বিষয় বেশ প্যারাদায়ক আর সেটা হচ্ছে ডিসপ্লে টেকনোলজি।
বাজেট ডিভাইসগুলোতে FHD+ কিংবা HD+ রেজুলেশনের IPS LCD প্যানেল দেওয়া থাকে, আবার মিডরেঞ্জের আপনি IPS LCD ডিসপ্লে স্মার্টফোন পাবেন কিন্তু মিডরেঞ্চে প্রায় সবাই AMOLED স্ক্রিণ খুঁজে থাকেন। তো আজকের পোষ্টে আমি চেষ্টা করবো স্মার্টফোনের LCD আর AMOLED এর পার্থক্যগুলো তুলে ধরার এবং এদের মধ্যে থেকে আপনার কোনটা নেওয়া উচিত সেটাও পোষ্টের শেষে তুলনা করার চেষ্টা করবো।
ভূমিকা:
মোবাইল ডিসপ্লে টেকনোলজি মূলত দুটি ভাগে বিভক্ত রয়েছে। ১) LCD এবং ২) AMOLED ডিসপ্লে। আবার ফ্ল্যাগশীপ ডিভাইসগুলোতে OLED স্ক্রিণও রয়েছে তবে সেটা AMOLED টেকনোলজির কাছাকাছিই বলতে পারেন, কিন্তু LCD আর AMOLED এর মধ্যেই রয়েছে যত পার্থক্য! বর্তমানে প্রায় সকল ডিভাইসগুলোতেই AMOLED স্ক্রিণের ব্যবহার হওয়া শুরু হয়েছে, যা আগে শুধুমাত্র ফ্ল্যাগশীপ ডিভাইসগুলোতেই ব্যবহৃত হত।
মানে কয়েক বছর আগে ফ্ল্যাগশীপ স্মার্টফোনতে AMOLED স্ক্রিণ , মিডরেঞ্জ ডিভাইসগুলোতে LCD স্ক্রিণ আর বাজেট ডিভাইসগুলোতে TFT স্ক্রিণ ব্যবহৃত হতো। যা এখন বর্তমানে ফ্ল্যাগশীপ স্মার্টফোনে 4K OLED স্ক্রিণ, মিডরেঞ্জ ডিভাইসে AMOLED আর বাজেট ডিভাইসে LCD স্ক্রিণ ব্যবহৃত হচ্ছে।
AMOLED আর OLED স্ক্রিণ টেকনোলজির মূল ভূমিকায় রয়েছে তাদের LED বা Light Emitting Diode ডিসপ্লে ধরণগুলো। আর AM এর অর্থ হচ্ছে Active Matrix । এখন এরা কিভাবে কাজ করে সেটা বুঝিয়ে বললেও আপনাদের অনেকেই বুঝবেন না তাই দরকার নেই।
তবে সহজ ভাষায় বললে AMOLED আর LCD দুটো স্ক্রিণই Pixel দিয়ে নির্মিত হয়েছে। একটি পিক্সেল তিনটি সাব-পিক্সেল নিয়ে গঠিত হয়। এই সাব-পিক্সেলগুলো হচ্ছে Red, Green এবং Blue । এই তিনটি রংয়ের সঠিক মিশ্রণে অন্য সকল রংকে ফুটিয়ে উঠানো যায়। স্ক্রিণে একটি নিদির্ষ্ট রং ফুটিয়ে তোলার জন্য প্রতিটি পিক্সেল তাদের ৩টি সাব পিক্সেল থেকে কিছু কিছুকে জ্বালিয়ে রাখে, আর সেভাবেই স্ক্রিণে আলাদা আলাদা রং ফুটে উঠে।
LCD আর AMOLED এর পার্থক্য শুরু হয় এখান থেকেই। LCD ডিসপ্লেতে এই লাইটগুলো একটি backlight থেকে জেনারেট হয়ে থাকে। কম দামি LCD ডিসপ্লেগুলোরে সাইডে সাইডে লাইট ব্লিডিংও আপনি খালি চোখে দেখতে পারবেন। আর এই backlight এর সুবিধা হলো এগুলো খুব কম দামে পাওয়া যায় তাই শেষে গিয়ে ওভারঅল স্মার্টফোনটির দাম কমে যায়। আর ডাউনসাইড হচ্ছে backlight পদ্ধতিতে লাইটকে ডিসপ্লের নিচ হতে বেরিয়ে আসতে হয় আর তাই এখানে (LCD) কালো রংকে আসলেই কালো হিসেবে ফুটিয়ে তোলা যায় না। কালো রং কে দেখবেন হালকা ধুসর ছোঁয়া লেগে থাকে। তাই Amoled স্ক্রিণ এর মতো ডার্ক ডিপ ব্ল্যাক এখানে পাবেন না।
অন্যদিকে AMOLED স্ক্রিণে প্রতিটি পিক্সেলের নিজস্ব লাইট সোর্স থাকে, মানে এখানে কোনো প্রকারের backlight এর প্রয়োজন পড়ে না। তাই কোনো রং দেখানোর জন্য শুধুমাত্র প্রয়োজনীয় পিক্সেলগুলোই উজ্জ্বল হয়ে থাকে। তাই এখানে কালার একুরেসি LCD এর থেকে অনেক বেশি থাকে। এ জন্যই AMOLED স্ক্রিণে আপনি ডিপ ডার্ক ব্ল্যাক দেখতে পারবেন। আর তাই এই জাতীয় স্ক্রিণে কালো ওয়ালপেপার দিয়ে রাখলে পিক্সেলগুলোকে বন্ধ রাখতে পারবেন তাই ব্যাটারি সেভও ভালো মতো হয়ে যাবে। সঠিক কালো রংয়ের ওয়ালপেপার দিয়ে রাখলে স্ক্রিণের ৯০% অংশের পিক্সেল বন্ধ থাকবে তাই ব্যাটারি সাশ্রয় হবে প্রচুর!
LCD এর সুবিধাগুলো:
> উজ্জ্বল সাদা = LED এর backlights গুলো সাদা রংকে পিক্সেলের মধ্যে দিয়ে বেশি পুশ করে থাকে, তাই এই LCD স্ক্রিণে বাইরের আলোতে স্ক্রিণের লেখা পড়তে সুবিধা হয়। (তবে বর্তমানে AMOLED স্ক্রিণে ১৫০০ নিট [Mi 11] পর্যন্ত ব্রাইটনেস পাওয়া যাচ্ছে !)
> বাস্তবধর্মী কালার = AMOLED এর খুব সুন্দর পাঞ্চি কালার পাবেন যেটা দেখতে খুবই সুন্দর লাগে। কিন্তু বাস্তবধর্মী কালার LCD তে পাওয়া যায় যেটা অনেকের কাছেই ভালো লাগে না।
> ভরসাযোগ্য = LCD স্ক্রিণগুলো AMOLED এর থেকে “সাধারণত” বেশি টেকসই হয়ে থাকে, হাত থেকে পড়ে গেলেই AMOLED স্ক্রিণ ভেঙ্গে যেতে পারে, যেখানে LCD স্ক্রিণ ভাঙ্গার সম্ভাবনা কম AMOLED এর থেকে।
> কম খরচ = LCD স্ক্রিণগুলো রিপেয়ার করতে টাকা অনেক কম লাগে AMOLED এর থেকে।
> ভিউ এঙ্গেল = LCD ডিসপ্লে গুলোতে ভিউ এঙ্গেলগুলো একটু বেশি বেটার হয়ে থাকে।
LCD এর অসুবিধাসমূহ:
> Deep Blacks = LCD ডিসপ্লেতে সবসময় backlight জ্বলে থাকে বিধায় একদম নিখুঁদ কালো রং এখানে পাওয়া যায় না।
> ফ্লেক্সিবল নয় = LCD ডিসপ্লেগুলোকে ফ্লেক্সিবল করা যায় না, তাই ফোল্ডেবল ফোন কিংবা Edge Curved যুক্ত ফোনে LCD ব্যবহৃত হয় না তাই এদের দাম বেশি হয়ে থাকে।
> মোটা ডিজাইন = LCD ডিসপ্লে গুলোর পেছনেও Backlight থাকার কারণে টোটালে স্ক্রিণ গিয়ে সাইজ মোটা হয়ে থাকে। তাই এই LCD ডিসপ্লের ডিভাইসগুলো অপেক্ষাকৃত মোটা হয়ে থাকে।
> In display ফিঙ্গারপ্রিন্ট = LCD তে In display ফিঙ্গারপ্রিন্ট ফিচারটি আনা সম্ভব নয়। আর Holepunch ক্যামেরা কাটআউটগুলো যদি LCD স্ক্রিণে ব্যবহার করা হয় তাহলে সেটা পারফেক্ট ভিউ দিতে পারে না।
> Always on Display: সিঙ্গেল পিক্সেল জ্বালানো সম্ভব হয় না দেখে এখানে আপনি Always on Display ফিচারটি পাবেন না।
AMOLED এর সুবিধাসমূহ:
> সঠিক রং: AMOLED স্ক্রিণের সবথেকে বড় সুবিধা হলো এখানে কালার একুরেসি খুব ভালো পাবেন। একটি AMOLED স্ক্রিণে একটি মুভি দেখে ওই মুভিটা যদি আপনি পরিবর্তে LCD তে দেখেন তাহলে LCD তে আপনার মনে হবে ফ্যাঁকাসে ফ্যাঁকাসে লাগসে।
> ডিপ ব্ল্যাক: AMOLED স্ক্রিণে আপনি ডিপ ব্ল্যাক পাবেন। একটি LCD স্ক্রিণে আপনি কালো রংকে ঠিক কালো রংয়ে পাবেন না, একটু ধূসর ধূসর লাগবে, কিন্তু AMOLED স্ক্রিণে কালো রংয়ে ঠিক কালো রংয়েই পাবেন। কালো রংয়ের অংশে পিক্সেল সরাসরি বন্ধ হয়ে যায় তাই কালো রংয়ের ওয়ালপেপার সেট করে রাখলে ব্যাটারি অনেক সাশ্রয়ী হয়।
> এনাজিং সাশ্রয়ী : AMOLED স্ক্রিণে পিক্সেলগুলো Individually চালু / বন্ধ হতে পারে দেখে এখানে আপনি এনাজিং সাশ্রয় করতে পারবেন। তাই অনেকেই সাজেস্ট করে যে AMOLED স্ক্রিণের ডিভাইসে কালো রংয়ের ওয়ালপেপার ব্যবহার করতে।
> ফ্লেক্সিবল: AMOLED স্ক্রিণগুলোকে ফ্লেক্সিবল করা যায়। তাই হাইয়ার লেভের স্মার্টফোনগুলোতে AMOLED স্ক্রিণের সাহায্যেই Flexible স্ক্রিণ, Curvable স্ক্রিণ এবং Foldable স্ক্রিণে এই AMOLED স্ক্রিণ ব্যবহার করা হয়। এই সকল ক্ষেত্রে LCD স্ক্রিণ ব্যবহার করা অসম্ভব।
AMOLED এর অসুবিধা সমূহ:
> দামী : AMOLED স্ক্রিণগুলো LCD এর থেকে অপেক্ষাকৃত ভাবে একটু বেশি হয়ে থাকে। তাই স্মার্টফোনের দামও শেষে গিয়ে বেশি হয়ে যায়। আর বর্তমানে AMOLED স্ক্রিণের দাম কমতে থাকলেও বাজেট সেকশনে এখানো AMOLED আসে নি।
> রিপেয়ার কস্ট বেশি: AMOLED স্ক্রিণ দামি হওয়ার কারণে এর জন্যে এর রিপেয়ার কস্টও অনেক বেশি হয়ে থাকে।
> কম টেকশই: এই কথার ভূল বুঝলে হবে না, ভেঙ্গে ফেলার টার্গেট থাকলে আপনি পাথরকেও ভেঙ্গে ফেলতে পারবেন। মানে চাইলে LCD স্ক্রিণকেও সহজেই ভেঙ্গে ফেলা যায় কিন্তু সাধারণ ব্যবহারের ক্ষেত্রে AMOLED স্ক্রিণের স্মার্টফোন LCD স্ক্রিণযুক্ত স্মার্টফোনের থেকে একটু কম টেকশই হয়ে থাকে। মানে হাত থেকে পড়ে গেলে LCD স্ক্রিণে ফাঁটার সম্ভাবনা কম থাকে কিন্তু AMOLED স্ক্রিণ হাত থেকে পড়ে গেলে আল্লাহ-বিল্লাহ করতে হয় যাতে না ফেঁটে যায়!
> চোখের ক্ষতি! : রাত্রের বেলায় ব্রাইটনেস কম করে কনটেন্ট দেখার সময় AMOLED স্ক্রিণ আপনার চোখের ক্ষতি করতে পারে, পাশপাশি দুটি LCD আর AMOLED স্ক্রিণের ব্রাইটনেস Dim করে নিয়ে একটি ক্যামেরায় দুটি স্ক্রিণের ভিডিও করলে দেখবেন যে AMOLED স্ক্রিণটি ফ্লিক করছে! এই সমস্যা থেকে বাঁচার জন্য DC Dimming অপশনটি ব্যবহার করতে পারেন, এটা ভোল্টেজ সাপ্লাই কম করে দিয়ে এই ফ্লিকারিং সমস্যাটির সমাধান করবে। হ্যাঁ এতে ক্লিয়ারিটি একটু কম পাবেন কিন্তু কম আলোতে AMOLED ডিসপ্লে ব্যবহারের সময় চোখের ক্ষতি থেকে বেঁচে যাবেন।
> যারা থার্ড পার্টি ট্রিগার দিয়ে গেমিং করে থাকেন তাদের জন্য AMOLED স্ক্রিণে একট সর্তকতা অবলম্বন করতে হবে। ট্রিগারটি বার বার একই স্থানে প্রেসার দেয় বিধায় বেশি দ্রুত বা খেলার জোসে এসে বেশি জোরে টিপ দিয়ে স্ক্রিণকে ফাঁটিয়ে দিতে পারেন!
আপনার কোনটা নেওয়া উচিত?
সাধারণ ইউজারদের কাছে AMOLED স্ক্রিণ ডিভাইস বেশি পছন্দের এবং জনপ্রিয় হয়ে থাকে। কারণ AMOLED স্ক্রিণে কালার বেশ ফুটে উঠে আর সুন্দর লাগে। তাই সাধারণ ইউজাররা একটু দাম দিয়ে হলেও বাজেটের বাইরে গিয়ে একটি AMOLED স্ক্রিণ নেওয়ার চেষ্টা করেন। এছাড়াও যারা স্মার্টফোনে প্রচুর কনটেন্ট ভিউ করেন যেমন মুভি, সিরিজ, নেটফিক্স ইত্যাদি তাদের জন্যও AMOLED স্ক্রিণের ডিভাইসই নেওয়া হয়ে থাকে। কারণ IPS LCD স্ক্রিণে কনটেন্ট ভিউ আর AMOLED স্ক্রিণের ভিউ এক্সপেরিয়েন্স পুরোপুরি দুটি আলাদা স্বাদের জিনিস!তবে হাত থেকে পড়ে গেলেই যে AMOLED স্ক্রিণ ভেঙ্গে যাবে সেই ব্যাপারটিও কিন্তু নেই। তবে আমার নিজের Huawei Nova 3i ডিভাইসে স্ক্রিণ অটোতে উঠে ভিড়ের মাঝে পকেটে হাতলের চাপে ভেঙ্গে গিয়েছিলো! যাদের হাত থেকে মোবাইল পড়ে যাওয়ার চান্স বেশি থাকে বা যারা রানিং জব করে থাকেন তাদের জন্য আমার সাজেস্ট থাকবে LCD স্ক্রিণের ডিসপ্লেযুক্ত স্মার্টফোন নিতে। তবে আপনার স্মার্টফোন কেনার বাজেটে যদি AMOLED যুক্ত কোনো ভালো ডিভাইস পেয়ে যান তাহলে অবশ্যই AMOLED কে মিস দিবেন না।
তবে আমাদের মতো নরমাল ইউজারদের জন্য এই দুটো ডিসপ্লে এর মধ্যে খুব বেশি তফাৎ নেই, দুটিতেই দুরকমের সুবিধা আর অসুবিধা রয়েছে। তবে আমাদের অভ্যাস হলো চোখে দেখে কোনটা ভালো লাগে সে হিসেবে স্মার্টফোন চয়েজ করে থাকি। আর AMOLED স্ক্রিণ চোখে দেখলে আসলেই আপনার ভালো লাগবে আর ফোনের ডিজাইন যদি Eye Catchy হয়ে থাকে তাহলে আর কোনো কথাই নেই!
যারা মোবাইলে ফটোগ্রাফি করে থাকেন তাহলে জন্য ছবিতে শার্পনেস এবং বাস্তবধর্মী রেজাল্ট এর দরকার হয়, যা LCD ডিসপ্লে থেকে সঠিক ভাবে পাওয়া যায়।
তো শেষ কথা হচ্ছে যে, আপনার কাছে বাজেট থাকলে অবশ্যই AMOLED স্ক্রিণ স্মার্টফোন নিবেন, তাহলে ডিসপ্লে কোয়ালিটির পূর্ণাঙ্গ মজা উপভোগ করতে পারবেন। তবে গেমার হয়ে থাকলে হাই রিফ্রেশরেট যুক্ত LCD স্ক্রিণ আপনার জন্য পারফেক্ট হবে।