অদ্ভুত সুন্দর এক চাঁদের রাতে, একটি গ্রাম্যঞ্চলে আপনি একা হেঁটে যাচ্ছেন! চারদিকে শুধু অন্ধকার, একমাত্র চাঁদের আলোতে আপনি হেঁটে চলেছেন আপনার হারিয়ে যাওয়া বউয়ের খোঁজে। হ্যাঁ এইরকমই সুন্দর এবং গাঁ ছম ছম করা একটি হরর গেম হলো এই আউটলাস্ট ২। গেমটি ২০১৩ সালের ব্লকবাস্টার আউটলাস্ট গেমের সিকুয়্যাল হিসেবে পাঁচ বছর আগে মানে ২০১৭ সালে বাজারে এসেছে। সঠিক পরিবেশে আপনি গেমটি খেলতে পারলে অবশ্যই আপনার গাঁয়ে কাটা দিয়ে উঠতে বাধ্য। আজ থেকে আপনাদের রিকোয়েস্টে আমি শুরু করছি পুরোনো মাস্টারপিস Old is Gold গেমসের রিভিউ নিয়ে। আর সিরিজের ১ম পর্বটি শুরু করছি আমারই খেলা সবথেকে সেরা Survival Horror ভিডিও গেম আউটলাস্ট ২।
Survival Horror ভিডিও গেমস হচ্ছে আসল ভৌতিক বা হরর ভিডিও গেম। এখানে আপনাকে বেঁচে থাকতে হবে বা Survive করতে হবে। এখন যদি আপনাকে বড় সড় অস্ত্র দিয়ে বলে যে ভুত প্রেত জুম্বি এলিয়েনদেরকে ঠুস ঠাসে করে মেরে Survive করতে তাহলে সেটায় কিন্তু ভয়ের তেমন একটা ফিল পাওয়া যাবে না। কিন্তু আপনার কাছে যদি কোনো অস্ত্র না থাকে, আর ভুত প্রেত জুম্বি এলিয়েনদের থেকে বাঁচার একমাত্র উপায় হলো তাদের থেকে দূরে থাকা বা তাদের দৃষ্টি এড়িয়ে চলা; তাহলে এখানেই রয়েছে আসল ভৌতিক গেমের মজা। আর সেই মজাটাই আউটলাস্ট গেমস সিরিজে দিয়ে রাখা আছে।
আউটলাস্ট ২ গেমের আগের গেম আউটলাস্ট (২০১৩) যারা যারা খেলেছেন তারা নিশ্চয় জানেন যে এই সিরিজের গেমগুলো কি রকম। আর একটি চমৎকার সিকুয়্যাল কাকে বলে তা এই আউটলাস্ট ২ গেমটির দিকে তাকালেই বুঝা যায়। আগের Outlast গেমটির থেকে শুধুমাত্র গ্রাফিক্সের দিকেই Outlast 2 উন্নত নয়, বরং গেমপ্লে, স্টোরিলাইন এবং সবথেকে ইউনিক বিষয় “ভয়” কে খুব সুন্দর ভাবে গেমটিতে সাজানো হয়েছে। হ্যাঁ পিলে চমকে দেবার মতো ভয় রয়েছে গেমটিতে।
আউটলাস্ট ২ হচ্ছে একটি ফার্স্ট পারসন Survival ভিডিও গেম যেটি নির্মাণ করেছে এবং একই সাথে প্রকাশ করেছে Red Barrels। গেমটি ২০১৩ সালের আউলাস্ট গেমটির সিকুয়্যাল হিসেবে ২০১৭ সালের এপ্রিলের শেষে দিকে বিশ্বব্যাপী মুক্তি দেওয়া হয়। আউটলাস্ট গেমটির সাথে মিল রেখে আউটলাস্ট ২ গেমটির ইউনিভার্স ঠিক রাখা হয়েছে তবে এখানে নতুন ক্যারেক্টার এবং ভিন্ন স্বাদের স্টোরিলাইন দেওয়া হয়েছে। মানে আগের গেমটির মতোই এটিও একটি Found Footage স্টাইলে খেলা যাবে। হলিউডের ভৌতিক ছায়াছবির মতোই গেমটি খেলার মজা পাওয়া যাবে। আর আগের গেমটির মতোই ভূতদের সাথে ফাইটিং এর চাইতে Run and Hide হিসেবে গেমটিতে বেশির ভাগ সময়ে আপনাকে খেলতে হবে। গেমটিতে কোনো মাল্টিপ্লেয়ার ফিচার নেই যেটি সিরিজের আগের গেম Outlast এবং Outlast: Whistleblower গুলোতেও ছিলো না। উল্লেখ্য যে স্টোরিলাইনে Anit-Christ জাতীয় অনেক বিষয়াবলী রয়েছে, তাদের এগুলো ভালো লাগে না তারা একটু সাবধানে থাকবেন।
গেমটির বর্ণনায় আমি ভূত বললেও গেমটিতে আসলে ভূত বলতে কিছু নেই। তবে গ্রামের মানুষজনের ব্যবহারও ভূত থেকে কম যায় না। আবার কালো জাদু বা ব্ল্যাক ম্যাজিকের কারবারিও রয়েছে গেমটিতে, তাই হরর গেমের আসল ফিল আনার জন্য এখানে আপনাদের সুবির্ধাতে ভূত কথাটা প্রয়োগ করেছি আমি।
একা একা রাতের বেলা কানে হেডফোন লাগিয়ে রুমে বসে বসে গেমটি একবার খেলে দেখুন, তাহলেই বুঝবেন কেন একে সেরা ভৌতিক গেম বলছি। বেয়ার গ্রিলসের একটি কথা এই গেমটির গেম-প্লে সাথে মিলে যায় আর তা হলো “বেঁচে থাকার লড়াই”। হ্যাঁ গেমটিতে আপনাকে বেঁচে থাকার জন্য লড়াই করতে হবে। এর জন্য আপনি গেমটিতে দৌড়াতে পারবেন, বিভিন্ন অবজেক্টের পিছনে লুকাতে পারবেন এবং সবথেকে মজার ব্যাপার গেমটিতে আপনি সরাসরি কিছু স্ক্রিপকৃত সিন ছাড়া অন্য কোথাও ভূতদের সাথে মারামরি করতে পারবেন না।
এছাড়াও আপনি একটানা বেশিক্ষণ ধরে দৌড়াতে পারবেন না। সিরিজের আগের গেমটির মতোই এখানেও আপনি ক্ষতস্থানে ব্যান্ডেজ করে নিয়ে হেলথ রিস্টোর করতে পারবেন । তবে ব্যান্ডেজ করতে কয়েক সেকেন্ড লাগবে এবং ভুতদের আক্রমণে ব্যান্ডেজিং মাঝপথেই থেমে যেতে পারে। আর রাতের অন্ধকারে পথ খুঁজে পেতে ভিডিও ক্যামেরার নাইট ভিশন ফিচারটি ব্যবহার করতে হবে, আর নাইট ভিশনটি ব্যাটারীর সাহায্যে চলে তাই গেমটিতে বেঁচে থাকার সাথে সাথে বিভিন্ন স্থানে পড়ে থাকা ব্যাটারিগুলোকেও সময়মতো আপনাকে খুঁজে বের করে নিতে হবে । গেমটির আরেকটি চমৎকার ফিচার হলো Enemy AI কে প্রথম গেমটির থেকে নতুন করে বানানো হয়েছে এবং এই গেমে ভূতগুলো আলাদা আলাদা র্যান্ডম পথ অনুসরণ করবে যাতে আপনি অনুমান করতে না পারেন কোন দিক থেকে ভূতগুলো আসবে।
গেমটিতে রয়েছে পাঁচ ধরনের ডিফিকাল্টি সেটিংস। এগুলোর প্রত্যেকটিই এক এক ধরনের চ্যালেঞ্জের স্বাদ আপনাকে উপহার দিবে। এগুলো হচ্ছে: Story Mode, Normal, Hard, Nightmare এবং Insane। Story Mode হচ্ছে গেমটির সবথেকে সহজ সেটিংস । এখানে Normal সেটিংস থেকে কম ডিফিকাল্টি থাকবে, ভূতগুলো একটু বোকাটে টাইপের হবে এবং ভূতদের আক্রমণে আপনি কম ডেমেজ খাবেন। স্টোরি মোড সেটিংসয়ে গেমটির স্টোরিলাইনের কিছু Chase Sequences এবং Chase Encounters গুলোকে মুছে দেওয়া হয়েছে এবং সহজতর করে রাখা হয়েছে। অন্যদিকে Hard এবং Nightmare মোডগুলোতে আপনি গেমটির ডিফিকাল্টি একটু বেশিই কঠিনতর হিসেবে পাবেন। এই মোডে ব্যাটারি খুঁজে পাওয়া একটু কঠিন হবে, ভূতগুলো বেশি আক্রমণাত্বক এবং দ্রুত আসতে পারবে, ভূতগুলো আপনার হাইডিং স্পটগুলোকে আরো গভীরভাবে পর্যবেক্ষন করতে পারবে এবং ভূতদের থেকে খাওয়া ডেমেজ বেশি হবে। এমনটিও হতে পারে অনেকসময় এক হিটে আপনি মারা যেতে পারেন। আর গেমটির Insane মোডটিতে আপনাকে বাস্তবিক লাইফের মতো খেলতে হবে, মানে হলো এই মোডে আপনাকে একবারও না মরে গিয়ে সম্পূর্ণ গেমটি গেমওভার দিতে হবে, একবার মরে গেল আপনাকে আবারো গেমটির একদম শুরু থেকে খেলতে হবে। আসলেই Insane!
ফার্স্ট পারসন হরর গেমগুলোতে এই ধরনের গেমপ্লে একদমই ইউনিক ভাবে Red Barrels কোম্পানিটি আউটলাস্ট সিরিজে নিয়ে এসেছে। আর গেমটিতে অবশ্যই আপনাকে মাথার বুদ্ধি খাটিয়ে এক একটি স্থান এক একটি লেভেল পার করতে হবে। গেমটির স্টোরিলাইন নিয়ে আমি এখানে কিছুই বলছি না কারণ স্টোরিলাইন জেনে গেলে গেমটি খেলে তেমন এক মজা পাবেন না। যদিও পাঁচ বছর আগের এই গেমটি ইতিমধ্যেই অনেকেই খেলে ফেলেছেন তবে কিছু জিনিস না বললেই নয়।
সিরিজের প্রথম গেমটিতে আপনি যেমন একজন ফ্রিল্যান্সার সাংবাদিকের ভূমিকায় খেলেছেন, একটি মানসিক হাসপাতালকে তদন্তে করতে গিয়ে বিভিন্ন ভয়াবহ পরিস্থিতির শিকার হয়েছিলেন ঠিক একই ধরনের সেটিংস আপনি আউটলাস্ট ২ গেমটিতেও পাবেন।
আউটলাস্ট ২ গেমটিতে আপনাকে একজনের রহস্যজনক মিসিং কেইসের জন্য তদন্তে যেতে হবে। আর এই সফরে আপনার সঙ্গ দিচ্ছে আপনার স্ত্রী। আপনি স্বস্ত্রীক হেলিকপ্টারে করে একটি গ্রাম্য অঞ্চলে যাচ্ছেন সেই রহস্যজনক মিসিং কেইসটিকে তদন্ত করতে। হঠাৎ হেলিকপ্টারটি দুর্ঘটনার শিকার হয় এবং আপনি জ্ঞান হারান। জ্ঞান ফিরে পাবার পর দেখেন যে আপনি রয়েছেন একটি ভুতুরে গ্রামে এবং আপনার স্ত্রীও মিসিং রয়েছে । গ্রামের বিভিন্ন স্থানে পড়ে থাকা কাগজের চিঠি এবং গ্রামের পরিবেশ দেখেই আপনি বুঝতে পারলেন যে এটি একটি ভৌতিক গ্রাম এবং কিছুক্ষণের মধ্যেই দেখলেন যে পুরো গ্রামটিই আপনাকে হত্যার জন্য ভয়ংকর ভাবে উঠে পড়ে লেগেছে। আর এরই মধ্য দিয়ে আপনাকে বেঁচে থাকতে হবে এবং আপনার স্ত্রীকে খুঁজে বের করতে হবে আর একই সাথে সেই মিসিং কেইসটিকেও সলভ করতে হবে। বলা বাহুল্য যে, অন্ধকারের স্থানগুলোকে যেখান চাঁদের আলো পৌঁছায় না সেখানে আপনার একমাত্র সাথী হবে আপনার ভিডিও ক্যামেরার নাইট ভিশন, আর সেটিকে একটিভ রাখার জন্য চাই ব্যাটারি। গ্রামের ভয়াবহ পরিবেশ আর ভূতগুলোর হাত থেকে বেঁচে থাকার পাশপাশি বিভিন্ন স্থান থেকে সঠিক সময়ে ক্যামেরার ব্যাটারিও আপনাকে সংগ্রহ করতে হবে। আর এই সকল কিছুই ঘটে যাচ্ছে ভয়ংকর সুন্দর চাঁদনি রাতে!
ভয়ংস্কর সুন্দর বলছি এ কারণে যে গেমটির গ্রাফিক্স বেশ চমৎকার এবং হাই গ্রাফিক্স সেটিংস দিয়ে গেমটি খেললে একটি ভৌতিক গ্রামের রাতের পরিবেশের আসল মজাটা আপনি পাবেন। হুহু হাওয়ায় গাছের পাতা নড়াটাও গেমটির গ্রাফিক্সে বেশ চমৎকারভাবে ফুটিয়ে তোলা হয়েছে।
তবে একটা বলতেই হবে যে, একদমই দুর্বল হৃদয়ের প্লেয়ার এবং বেশি ছোট বাচ্চাদের এই গেমটি খেলতে দেওয়া যাবে না। আর যারা মাথা ঘাটিয়ে ভিডিও গেমস খেলা পছন্দ করেন না তারা এই গেমটি থেকে দূরে থাকবেন। কারণ গেমটির শুরু করার মাত্র ১০ মিনিটের মাথা থেকেই আপনাকে বুদ্ধি খাটিয়ে গেমের গল্পের সামনে দিকে এগিয়ে যেতে হবে। আমি নিজেই গেমটির এক পর্যায়ে একটি গমক্ষেতের আশেপাশেই আধা ঘন্টা ধরে শুধু ঘুরে বেরিয়েছি কিভাবে ভূতদের হাত থেকে বেঁচে সামনে দিকে এগিয়ে যেতে হয় সেটা চিন্তা করে।
সিরিজের প্রথম গেমটির পটভূমি ছিলো একটি হাসপাতাল ঘিরে আর পরিত্যাক্ত হাসপাতাল কথাটা শুনতেই মনের মধ্যে একটি ভূতুরে পরিবেশের চিত্র চলে আসে। কিন্তু আউটলাস্ট ২ গেমটিতে গ্রাম্য ভূতের পরিবেশকে গ্রাফিক্স এবং চমৎকার সাউন্ডের ব্যবহারের সাহায্যে ফুঁটিয়ে তোলা হয়েছে যা আসলেই প্রশংসার যোগ্য।
পরিশিষ্ট:
চমৎকার গ্রাফিক্স আর অসাধারণ সাউন্ড ইফেক্টের কারণেই কিন্তু আউটলাস্ট ২ গেমটি আপনাদের কাছে বেশ “ভয়ংকর” মজাদার লাগবে। আর তাই গ্রাফিক্স ও সাউন্ড ইফেক্ট এর জন্য আপনার চাই একটি মিডিয়াম রেঞ্জের গেমিং পিসি আর হেডফোন। আমার কথা বলতে গেলে ২০১৮ সালে যখন গেমটি খেলেছিলাম তখন আমার পিসি ছিলো ৬ষ্ঠ প্রজন্মের কোর আই ৭ প্রসেসর, ১৬ গিগাবাইট র্যাম, ২ গিগাবাইটের রাডিয়ন গ্রাফিক্স কার্ডযুক্ত কনফিগারেশনের। তখন বেশ ভালো করেই গেমটি উপভোগ করেছি আমি। আশা করবো যারা যারা এখনো গেমটি খেলেননি তারা গেমটি খেলে আমার মতোই মজা পাবেন। তবে সিরিজের প্রথম গেমটি যারা এখনো খেলেনটি তারা সরাসরি আউটলাস্ট ২ দিয়েও সিরিজটি শুরু করতে পারেন কারণ আগেরটার সাথে এটা স্টোরিলাইনে কোনো সম্পর্ক নেই। তো ভয় পেতে যারা ভালোবাসেন তারা আজই খেলে নিতে পারেন চমৎকার এই গেমটি।
The Outlast Trials নামে সিরিজের পরবর্তী গেমটি এ বছরের শেষের দিকে রিলিজ পাবে বলে শুনছি। গেমটি নাকি আগের ২টি গেমের প্রিকুয়েল হিসেবে স্টোরিতে আসবে। দেখা যাক এবারের গেমে আমাদের জন্য কি থাকছে।