ফাস্ট চার্জিং এর সম্পূর্ণ ইতিহাস

শুরুর আগে কিছু কথা। জাভা সিম্বিয়ানের যুগে মোবাইলের ব্যাটারি ইউজার এবং ডেভেলোপার দুইপক্ষের কারো কাছেই তেমন একটা চিন্তার বিষয় ছিল না। ডিভাইস পাওয়ার আপ করার জন্য একটা ভোল্টেজ সোর্সই যথেস্ট ছিল। কিন্তু, আইওএস/এন্ড্রয়েডের যুগে প্রবেশ করার পর প্রেক্ষাপট ধীরে ধীরে পরিবর্তিত হতে থাকে। মোবাইল কোম্পানি যে এক এক ধরণের ফিচার ইন্ট্রোডিউস করতে থাকে তা সব কিছুই বেশি পাওয়ার হাংগ্রি হয়ে উঠতে থাকে। যার কারনে আমরা দেখতে থাকলাম ব্যাটারি পাওয়ার 1000 mAh থেকে মডেল ভেদে বতর্মানে 5000 mAh বা তারও বেশি গিয়ে ঠেকেছে। কিন্তু সাইজে বড় ব্যাটারি দিতে গিয়ে নতুন সমস্যার উদ্ভব হয় আর সেটি হল ব্যাটারির চার্জিং টাইম। দেখা যাচ্ছে যতই ব্যাটারি যতই বড় দেয়া হচ্ছে, চার্জিং টাইম ততটাই বেড়ে যাচ্ছে। এই পরিস্থিতি থেকে রেহাই পাওয়ার জন্য কোম্পানিরা যে একটি নতুন টেকনোলজির উদ্ভাবন করে নাম যা সবার কাছে এখন ‘ফাস্ট চার্জিং’ নামে পরিচিত। এই ফাস্ট চার্জিং এর বিভিন্ন বিষয় নিয়েই আজকের আর্টিকেল।

ফাস্ট চার্জিং যেভাবে কাজ করে

একটা বড় সাইজের ব্যাটারি অল্প টাইমে চার্জ করার জন্য আপনাকে একক সময়ে বেশি পাওয়ার পুশ করতে হবে। পাওয়ার বা ক্ষমতার মাপা হয় ওয়াট(watt) দিয়ে । এখন যদি ওয়াটের সমীকরনের দিকে লক্ষ্য করি তাহলে দেখা যাচ্ছে

Watt = Voltage X Ampere

তাহলে দেখা যাচ্ছে Voltage অথবা Ampere যেকোনো একটি বাড়ালে ওয়াট বৃদ্ধি পাবে। হাই ভোল্টেজ লো কারেন্ট অথবা লো ভোল্টেজ হাই কারেন্ট এইভাবে ব্যালেন্স করে ওয়াটেজ বাড়ানো হয়। আর ওয়াট বাড়াতে পারলেই বলা যায় চার্জিং টাইম কমে আসবে। যদিও ইচ্ছামত ওয়াটেজ বাড়ানো যায় না কিছু লিমিটেশন রয়েছে যেগুলো নীচের অংশ পড়তে থাকলে পেয়ে যাবেন।

এটিই হচ্ছে মেইন এন্ড বেসিক ম্যাকানিজম ফাস্ট চার্জিং এর পিছনে। যত ফাস্ট চার্জিং টেকনোলজি বর্তমানে এভেইলেবল তারা কম বেশি, হয় Voltage অথবা Ampere যেকোনো একটিকে বাড়িয়ে কমিয়ে নিজেদের ফোনের মাদারবোর্ডের সাথে সামঞ্জস্য করে ফাস্ট চার্জিং ফিচারটি ইউজারদের কাছে অফার করে। অবশ্য, বেশির ভাগ ম্যানুফেকচারার ভোল্টেজ পরিবর্তন করে থাকে।

ম্যানুফেকচারার ভেদে ফাস্ট চার্জিং একেক নামে পরিচিত। যেমনঃ Qualcomm এর ফাস্ট চার্জিং Quick Charge নামে পরিচিত। আবার MediaTek এরটা PumpExpress, Motorola এর TurboCharge , Oneplus এর DashCharge নামে পরিচিত। যেহেতু চিপসেট হিসেবে Qualcomm Snapdtragon SoC এর ব্যবহার অনেক বেশি সারা বিশ্বে তাই Quick Charge অপশনটিই আমরা একটু বেশি দেখতে পাই। তাই আপাতত আজকের আর্টিকেলে কোয়ালকমের Quick Charge এর বিভিন্ন ভার্সনের ইভোলুশন নিয়ে আলোচনা থাকবে।

Quick Charge 1.0 or QC1.0

ট্রেডিশনাল 5v/1A থেকে বের হয়ে কোয়ালকম 5V/2A সর্বোচ্চ ১০ ওয়াট ক্ষমতাসম্পন্ন QC1.0 Technology  মার্কেটে ইন্ট্রোডিউজ করে তাদের স্ন্যাপড্রাগন ৬০০ চিপসেটের মাধ্যমে । কোয়ালকম জানায় থিওরিটিক্যালি আগের তুলনায় ৪০% চার্জিং টাইম কমে আসবে।

Quick Charge 2.0 or QC2.0

সময়ের পরিক্রমায় মোবাইলের স্ক্রিন বড় থেকে বড় হতে থাকে। অন্য দিকে ফোন স্লিম রাখার জন্য ও অন্যান্য কারনে ব্যাটারির সাইজ বাড়ানো যাচ্ছিলো না। তাই কোয়ালকম QC2.0 নিয়ে  আসে যা আগের ভার্সন থেকে অনেক ইফেক্টিভ। এই টেকনোলজি ফিক্সড ভেরিয়েবল ভোল্টেজ/এম্পেয়ার এ কাজ করে । কারন এতে মাল্টিপল ভোল্টেজ যেমন 5/9/12V & 1.5/2A  দেয়া হয় যেখানে সর্বোচ্ছ ওয়াটেজ হচ্ছে 18। মজার ব্যাপার হল ভেরিয়েবল ভোল্টেজ এর কারনে লো ব্যাটারিতে চার্জ দিলে হাই ভোল্টে চার্জ হবে। আবার ব্যাটারি ৭০-৮০ পারসেন্টে গেলে ব্যাটারির গুড হেলথ মেইনটেইন করার এজন্য লো ভোল্ট চার্জিং  নেমে আসবে। তাছাড়া কোয়ালকম দাবি করে প্রচলিত কনভেনশনাল চার্জিং থেকে ৭৫% ফাস্ট চার্জিং হবে।সাথে Duel Charge Technology এড করা হয় যা দিয়ে চার্জিং একটা ব্লকে না হয়ে একই সাথে বিভিন্ন ব্লকে হবে।

Quick Charge 3.0 or QC3.0

ব্যাটারির হেলথ, তাপমাত্রা ,ওভার চার্জিং,ওভার হিটিং বন্ধ করাসহ কয়েকটি বিষয় এর উপর সর্বদা মনিটর করা লাগে। কুইক চার্জিং লাইনআপের মোস্ট সিগনিফিকেন্ট স্টেপ হচ্ছে  QC3.0। এই ভার্সন এর কারনে QuickCharge Technolongy এর পুরো ইকোসিস্টেম একটা ব্যালেন্সড ইকোসিস্টেম এ পরিণত হয়। এতে তাঁরা প্রথম বারের মত INOV চার্জিং এলগিদম এড করে।  যার ফলে চার্জিং হয় আরো ইফিসিয়েন্ট । সোজা কথায় INOV হচ্ছে এমন একটি এলগরিদম ব্যাটারিতে  যেটি দ্বারা ব্যাটারি ঠিক যত ভোল্টেজ নেয়া দরকার ঠিক তত টুকুই নিবে। আগের ভার্সন গুলোতে এত ফাইন টিউড এলগরিদম ছিল নাহ যার কারনে ব্যাটারির প্রয়োজন ছাড়াও এক্সট্রা পাওয়ার ডেলিভার করা হয়ত এডাপ্টার থেকে ফলে একদিকে যেমন পাওয়ার লস অন্যদিকে ব্যাটারির টেম্পারাচার অকারনেই বেড়ে যেত এবং ব্যাটারির স্থায়িত্ব ধীরে ধীরে কমে যায়।

3.6V -20V পর্যন্ত ভোল্টেজ রেঞ্জ পুরোটায় ডাইনামিক ভেরিয়েবল কিন্তু QC2.0 এর মত ফিক্সড ভেরিয়েবল না। যেখানে যখন খুশি ব্যাটারি চাইলেই যেকোনো ভোল্টেজ নিতে পারবে এবং ইঙ্ক্রিমেন্ট  ডিক্রিমেন্ট হবে 200mV করে ।  কারেন্ট হচ্ছে 3A । ওয়াটেজ হচ্ছে প্রিভিয়াস জেনারেশন এর মত 18W। যখন ব্যাটারির টেম্পারেচার বেশি থাকবে INOV অটোমেটিক লো INOV ডেলিভার করবে এবং ব্যাটারি কুল ডাউন হইলে হাই ভোল্টে চার্জ হবে।

কোয়ালকম দাবি করে QC3.0 এ ইফিশিয়েন্সি ৩৮% বেশি। চার্জিং টাইম ২৭% ফাস্টার  QC2.0 থেকে। এবং হিটিং ৪৫% কমিয়ে আনা হয়েছে। আগের দুই ভার্সনের ক্ষেত্রে চারজিং ক্যাবল বা তার ম্যাটার না করলেও  QC3.0 এর ক্ষেত্রে 20V কোনো নরমাল ক্যাবেল পাস করতে পারবে নাহ। যার কারনে একটা ভালো ক্যাবল প্রয়োজন। এছাড়াও, QC3.0 তে প্রথমবারের মত USB-C সাপোর্ট দেয়া হয়, যেটি প্রিভিয়াস দুটি ভার্সনে ছিল নাহ।

Quick Charge 4.0 or QC4.0

গুগলের বাধ্যবাধকতার কারনে কোয়ালকমকে কুইক চার্জ ইকোসিস্টেমকে USB PD(power delievery) কমপ্লায়েন্ট করতে হয় । তাই কোয়ালকম QC4.0 লঞ্চ করে তাদের চিপসেট স্ন্যাপড্রাগন ৮৩৫ এর মাধ্যমে।

এইখানে USB PD compliant বিষয়টা সংক্ষেপে বলা যাক।PD হল এমন একটা পাওয়ার সিস্টেম যেখানে সব ডিডাইস(ফোন, ল্যাপটপ, এক্সেসরিজ ইত্যাদি) যাতে একই চার্জার ইউস করতে পারে। গুগল/এপলের লেটেস্ট ফোন গুলো PD-এনাভেলড। এর রেঞ্জ হচ্ছে আপটু ১০০ ওয়াট। এবং এর পাওয়ার ডিরেক্টশন ফিক্সড নাহ।

কোয়ালকম QC4.0 এ কিছু আপডেট নিয়ে আসে যেমনঃ Duel Charge++ এবং INOV3.0। যা প্রিভিয়াস জেনেরেশন থেকে ইফিশিয়েন্ট। এছাড়াও Battery Saving Technology এড করা হয়। অনেক গুলো সেফটি গার্ড এড করা হয়। ক্যাবল কোয়ালিটি ডিটেকশন নিয়ে আসা হয় যাতে লো-কোয়ালিটি এবং নন কম্প্যাটিবল ক্যাবল অটো ডিটেক্ট হবে এবং চার্জিং শুরু হবে না।

QC4.0 এর রিলিজ দেওয়ার সময় যে প্রধান দুটি লক্ষ্য করা হয়

৫মিনিট চার্জিং এ ৫ঘন্টা ব্যাটারি লাইফ

০ থেকে ৫০% চার্জিং হবে মাত্র ১৫ মিনিটে

*এখানে ব্যাটারির সাইজ ধরা হয়েছে 2750mAh.

আরেকটি মেইন আপগ্রেড হচ্ছে কোয়ালকম দাবি করে QC2.0 থেকে ৫ডিগ্রি কম তাপমাত্রায় চার্জ হবে। এর কারন হচ্ছে  QC4.0 এ তাঁরা ১২/২০ ভোল্ট বাদ দিয়ে দেয়। লিথিয়াম ব্যাটারিতে বেশি ভোল্টেজ পুশ করলে ব্যাটারি খুব তাড়াতাড়ি হিট হয়ে যায়। তাই তাঁরা 5V এ  ম্যাক্সিমাম 5.6A, 9V এ ম্যাক্সিমাম 3A যার ফলে সর্বোচ্চ ওয়াটেজ হয় 28W  যা QC2.0 থেকে ১০ ওয়াট বেশি।আফটার ফল যত হিটিং কম তত ব্যাটারির লংজেভিটি বেশি।ইঙ্ক্রিমেন্ট  ডিক্রিমেন্ট হবে 20mV করে যা আগের ভার্সন থেকে অনেক প্রিসাইস।

স্ট্যাটিস্টিক্যাল ডাটা হিসেবে কোয়ালকম জানায় QC3.0 থেকে QC4.0

20% ফাস্টার

50% এফিসিয়েন্ট

Quick Charge 4+ or QC4+

এখনও  পর্যন্ত কোয়ালকমের লেটেস্ট টেকনোলজি হচ্ছে QC4+ যা লঞ্চ করে স্ন্যাপড্রাগন 845 প্রসেসর এর মাধ্যমে। নাম দেখেই অনুমান করে ফেলার কথা এইখানে কোনো মেজর আপডেট থাকছে নাহ। বরং কিছু মাইনর আপডেট থাকছে। কিন্তু ম্যাক্সিমাম পাওয়ার 28W  থাকছে আগের মতই। তবে QC4.0 থেকে বেশ কিছু আপগ্রেড পেয়েছে এই ভার্শন।

15% ফাস্টার

30% এফিসিয়েন্ট

তিন ডিগ্রি কুলার

তাছাড়াও এতে Advanced Safety Feature, Thermal Balancing সহ আগের সব ফিচার তো থাকছেই।

Qualcomm Quick Charging এর জন্য কি কি প্রয়োজন?

বেসিক্যালি দুটি জিনিস

চিপসেটে QC সাপোর্ট থাকা

Qualcomm সার্টিফাইড এডাপ্টার

কিছু ফ্যাক্ট

  • চিপসেটে Quick Charging এর কোনো একটা ভার্সন থাকলেই অনেক সময় ইউজার এর বেনিফিট নিতে পারে নাহ। কারন হল Quick Charging সাপোর্ট এর জন্য চিপসেট প্রতি Qualcomm কে একটা নির্দিষ্ট ফি দিতে হয়। যদি ফোন ম্যানুফেকচারাররা কস্ট কমানোর জন্য যদি এটা দিয়ে নাহ চায় তাহলে মাদার বোর্ড থেকেই এটা অফ করে রাখা হয়। যেমনঃ Xiaomi S2 এর চিপসেট Snapdragon 625 এ অরিজিনালি QC3.0 ইন্ট্রিগেটেড করে দিলেও বাস্তবে S2 তে কুইক চার্জের কোনো ভার্সনই সাপোর্ট করে নাহ।

 

  • আবার অনেক সময়  ম্যানুফেকচারাররা Quick Charging দিলেও সেটা আনাউন্স করে নাহ কারন আউট অফ দ্য অফ বক্স যে আডাপ্টার দেয়া হয় সেটা Qualcomm সার্টিফাইড এডাপ্টার Quick Charging এর ঐ ভার্সনের নাহ। যেমনঃ  পোকোফোন QC4+ সাপোর্টেড হলেও শাওমি ইন্ট্রোডিউস করানোর সময় বলে পোকোফোন  QC3.0 সাপোর্টেড। কারন শাওমি বক্সের সাথে দেয়া চার্জারটি ছিল QC3.0 এর।

 

  • Quick Charge পুরা ইকোসিস্টেম ব্যাকওয়ার্ড কম্পিটেবল। মানে হল QC4+ সার্টিফাইড চার্জার দিয়ে ইসিলি QC4+ সহ QC4.0, QC3.0 ও QC2.0 সাপোর্টেড যেকোনো মোবাইল চার্জ দেয়া যাবে এবং ঐ ভার্সনের প্যারামিটার অনুযায়ী চার্জ হবে।

 

  • Qualcomm সার্টিফাইড এডাপ্টার দিয়ে সহজেই কুইকচার্জ সাপোর্ট করে না এমন মোবাইল চার্জ দেয়া যাবে। অবশ্য সেই ক্ষেত্রে তা নরমাল এডাপ্টার হিসেবেই কাজ করবে। এবং এক্সপ্লোড হওয়ার কোনো সম্ভাবনা নেই। 

Share This Article

Search